জলবায়ু পরিবর্তন কেন গুরুত্বপূর্ণঃ
আবহাওয়া
একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশদুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি দেশ। জলবায়ু-সম্পর্কিত যেসমস্ত দুর্যোগগুলো রয়েছে তার মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধ্বস, নদীতীর ক্ষয়, শৈত্য প্রবাহ, দাবদহ, শিলাবৃষ্টি, ভারী বৃষ্টিপাত, নরওয়েস্টার, ঝড় এবং টর্নেডো ইত্যাদির প্রকোপ অনেক বেশি। উল্ল্যেখ্য, ২০১৪- ২০২০ থেকে, জলবায়ু -সম্পর্কিত প্রধান বিপর্যয়ের ফলে ১০৫৩ জন প্রান হারিয়েছে, ৪.৬ মিলিয়ন বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এতদকারনে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমান দাঁড়িয়েছে ৪.১ মিলিয়ন ডলার । ইনফরম (INFORM) সূচক অনুসারে, বাংলাদেশের ঝুঁকির মান দাঁড়িয়েছে ৫.৮ (১-১০ স্কেলে)। ২০২১ সালে দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ২৭তম ।
১. বন্যা ও ভূমিধ্বস: ভারি মৌসুমি বৃষ্টি এবং উজান থেকে আসা পানির কারণে সৃষ্ট বন্যায় বাংলাদেশের ৩৬ শতাংশ নিচু এলাকা দ্রুত প্লাবিত হয়। চট্টগ্রাম বিভাগে, বিগত ১০ দিনে রেকর্ড ১৫০ মিমি সহ অবিরাম ভারী বর্ষণের কারনে ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিধ্বসের সৃষ্টি করেছে। এইচসিটিটি (HCTT) নেক্সাস স্ট্র্যাটেজি (২০২১-২০২৫) অনুসারে, ২০টি জেলা অত্যন্ত উচ্চ এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বন্যাপ্রবণ জেলা হিসেবে সনাক্ত হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ গত ১২২ বছরের মধ্যে ২০২২ সালে, সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়, যার ফলে ৭.২ মিলিয়ন মানুষ (৩.৫ মিলিয়ন শিশু) ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
২. ঘূর্ণিঝড়: প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং ঝড়ের কারণে ১১ টি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ জেলায় বসবাসকারী মানুষ ক্ষয়ক্ষতি, বিপর্যয় ও দুর্ভোগের শিকার হয়। বঙ্গোপসাগরের ফানেল আকৃতির উত্তর অংশে যখন ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগে আছড়ে পড়ে তখন জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়। যার ফলে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৮৭৭-২০১৭ সালের মধ্যে, বাংলাদেশে ১৫৪টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, যার মধ্যে ৫৩টি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় ৪৩টি ঘূর্ণিঝড় এবং ৬৯টি ক্রান্তীয় নিম্নচাপ রয়েছে। ২০২১ সালের মে মাসে, ঘূর্ণিঝড় 'ইয়াস' এর ফলে বাংলাদেশের পশ্চিমে ৯ জন নিহত সহ ১.৩ মিলিয়ন মানুষ চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। ২০২০ সালের মে মাসে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ল্যান্ডফলে ১৯টি জেলার ১০ মিলিয়ন মানুষকে প্রভাবিত করেছিল এবং যা ১০০,০০০ মানুষকে গৃহহীন করে ফেলেছিল।
৩. ভূমিকম্প: বাংলাদেশ দুটি সক্রিয় প্লেটের সীমানার কাছাকাছি অবস্থিত: পশ্চিমে ভারতীয় প্লেইট এবং পূর্ব ও উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেইট। এই প্লেইটগুলির ত্রুটিপূর্ণ অবস্থানের কারনে এম৮ এর উপরে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। সিসমিক ম্যাক্রো-জোনেশন স্টাডি অনুসারে, শহরাঞ্চল যেমন, চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা, রংপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রাজশাহী সম্ভাব্য সিসমিক সক্রিয় অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। অতীতে, বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে যা জীবন ও সম্পদের মারাত্মক ক্ষতির কারন হয়েছিল। ১৫৪৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে, বাংলাদেশ প্রায় ২৭টি ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছে।
৪. তাপপ্রবাহ: ধারণা করা হচ্ছে, তীব্র তাপপ্রবাহ এবং আর্দ্র লঘু চাপ ২১ শতকে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর প্রতিনিয়ত প্রভাব ফেলবে।এবং বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব জীবিকা’র ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
৫. ক্ষরা: বৃষ্টিপাতের তারতম্য জায়গাভেদে একেক রকম। এবং এ তারতম্যের কারণে ক্ষরা দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপঃ মৌসুমী বায়ু পরিবর্তনের ফলে এশিয়ায় বন্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষরা বাংলাদেশের অনেক স্থানে প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল উচ্চ-ঝুঁকির মধ্যে থাকা অঞ্চলগুলোর মধ্যে থাকা একটি।
খাবার
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে শস্য ডুবে যায় আবার অল্প বৃষ্টিপাতের ফলে ক্ষরা দেখা দেয়। তাপমাত্রা বেশি হলে কীটপতঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে ও রোগজীবানুর সংক্রমন হয় । এর ফলে শস্য ও গবাদি পশু মারা যায়। যা দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে।
সামুদ্রিক স্তর
গ্রীণল্যান্ড ও এন্টার্কটিকায় বরফ গলে যাবার কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। যেহেতু গরম অবস্থায় পানির প্রসারন হয় তাই সমুদ্রের ব্যাপ্তি বাড়ার কারণেও সমুদ্র পৃষ্ঠের পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জ ও বাংলাদেশের মত নিম্নাঞ্চলের দেশগুলো এর ফলে বিশেষভাবে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। উষ্ণ সমুদ্র কার্বনকে দ্রবীভূত করতে পারে না (ফুটন্ত পানিতে যেভাবে বুদবুদ তৈরী হয়), আর তাই সমুদ্র পৃষ্ঠ যত গরম হয় এটি তত বেশি কার্বন নিঃসরন করে। এবং এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন আরো বেশি ত্বরান্বিত হয়।
স্বাস্থ্য
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে উষ্ণতা প্রিয় কীট-পতঙ্গ যেমন- মশা, বিস্তার লাভ করে এবং মানুষের মধ্যে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও জিকার মতো রোগ-জীবানু ছড়ায়। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিট স্ট্রোকে মৃত্যুহারও বাড়ে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ; জীবাশ্ম জ্বালানী এবং দাবানল, যা বায়ুদূষণের মাত্রা অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যার ফলে, ক্যান্সার, হৃদরোগ, শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা, ত্রুটিপূর্ণ মেধার বিকাশ এবং অপরিণত শিশু জন্মানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
সংঘাত ও প্রশমন
এই সমস্যাগুলো যখন মাত্রাতিরিক্ত আকার ধারণ করে তখন মানুষ নিরাপত্তার সন্ধানে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়। প্যাসিফিক দ্বীপের বেশ কিছু বাসিন্দা সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বাড়ার কারণে ঘর বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে বন্যা ও ক্ষরার কারণে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে ইন্ডিয়া, সুদান পর্যন্ত সর্বত্র অভিবাসন বেড়ছে। স্বভাবতঃ অভিবাসন যত বাড়বে দুঃষ্প্রাপ্য সম্পদগুলো নিয়ে প্রতিযোগীতা তত বাড়বে। এর ফলে পুরোনো সংঘাত মাথা চাড়া দেবার পাশাপাশি নতুন দ্বন্দ সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জীববৈচিত্র্য
মানুষ ও প্রকৃতি (যেমনঃ বন্যা ও আগুন) প্রাণিসহ আবাসস্থল ধ্বংস করতে পারে। কিছু প্রাণির খাওয়া ও বংশবৃদ্ধির জন্য শীতলতা প্রয়োজন, আবার এমনও অনেক প্রাণি আছে যারা অধিক তাপে প্রাণ হারায়। উদাহরণস্বরুপঃ সমুদ্র উত্তপ্ত হলে প্রবাল মারা যেতে পারে। এই প্রবাল হলো সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের মেরুদন্ডসরূপ। মানুষের কারণে গত ৫০ বছরে সমস্ত প্রানির ৬০% এরও বেশি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
অন্ততঃ ১ লক্ষ্য প্রজাতির প্রাণি ও উদ্ভিদ বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। এটা শুধু তাদের জন্যই নয় বরং মানুষের জন্যও হুমকি। কারণ আমাদেরকে একটি সুস্থ্য বাস্তুতন্ত্রের (ইকোসিস্টেম) ওপর নির্ভর করতে হয়। কীট-পতঙ্গ আমাদের শস্যের পরাগায়ন ঘটাতে সাহায্য করে, লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্য হিসেবে মাছের ওপর নির্ভরশীল, অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণি থেকে ঔষধ তৈরী হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন আমরা গাছপালা ও জলজ উদ্ভিদ থেকে পাই।